বিশেষ প্রতিনিধি:
নদীর বুকে এক গ্রাম,ছোট ফেনীর নদীর তীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে এক সময়ের সবুজ, আজকের আংশিক ক্ষয়ে যাওয়া গ্রাম চরপার্বতী।যে গ্রাম জোয়ার-ভাটার ছন্দে বেঁচে আছে, নদীর। গর্জনে ঘুম ভাঙত, আর নদীর বুকেই হারিয়ে যায় জীবনের গল্প।এ গ্রামের মানুষের সকাল শুরু হয় নদীর ঢেউয়ের শব্দে, শেষ হয় নদীর তীব্র স্রোতের ভয় নিয়ে।তবুও তারা নদীর সন্তান, তাই নদীকে ভালোবাসে, নদীকেই ভয় পায়।pp তদান্তদীন পাকিস্হান আমলে১৯৬২ সালের দিকে সোনাগাজী ও কোম্পানিগঞ্জ রক্ষার জন্য প্রথমে বেড়িবাঁধ নির্মান করে পাউবো প্রশাসন, পরবর্তীতে কোম্পানিগঞ্জ ও সোনাগাজী উপজেলার উওর চর সাহাভিকারী সীমান্তে চরপার্বতীর গ্রামের,দক্ষিনে, বসুরহাট টু মৌলবি বাজার টু কাজীর হাট সড়কে স্লুইসগেট কাজ শুরু করে পাউবো যাহা ১৯৬৫ সালে নির্মানের কাজ শুরু করে ১৯৬৭ সালে শেষ করে, কর্তৃপক্ষ আশা ছিল উভয় উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম নদী ভাঙ্গা হতে রক্ষা পাবে, রক্ষা পেয়ে ছিল প্রায়! তিন যুগ, সুইচগেটটি ছিল ২০টি ঢাকনাওয়ালা, সুইচগেট তখন ছিল নদী ও মানুষের মধ্যে ভারসাম্যের প্রতীক।জোয়ারের পানি আটকানো, ভাটার সময় পানি নিষ্কাশন সবকিছু চলত নিয়মে।কৃষকরা তখন আশায় বুক বাঁধতেন, নদীর নোনা পানি থেকে মুক্তি পেয়ে সবুজ ধানক্ষেত দুলত বাতাসে।কিন্তু সময়ের স্রোত কারো জন্য থেমে থাকে না।২০০২ সালের ভয়াবহ বন্যা, প্রবল স্রোতে সেই স্লুইসগেট ভেঙে যায়, অনেক স্হানীয় লোক বলছেন, সুইচগেট তদারকির কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সুইচ গেট দেখ ভালো করে রাখার যে নিয়ম তা না করা,
জানতে যান্ত্রিক অব্যস্হাপনা, জেলেদের মাছ আটকানো, নোনা পানি, কারনে গেটটি ভেঙ্গে যায়। ফলে মানুষজনের যাতায়াতের সমস্যা প্রকট ধারন করে, আর ভেঙে যায় চরপার্বতীর মানুষের শান্তির স্বপ্ন।তখন দেশের শাসনভার ছিল বিএনপির হাতে, নোয়াখালী (কোম্পানিগঞ্জ - কবিরহাট) সংসদীয় আসনের সংসদ সদস্য বিএনপির নেতা মরহুম ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমদের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনায় নির্মাণ করেন মুসাপুর সুইচগেট।মানুষ তখন কিছুটা স্বস্তি পায়। নদীভাঙন থেমে যায়, ফসল ফিরে আসে, জীবন আবার ধীরে ধীরে চলতে শুরু করে।তবে ব্রিজহীনতার বেদনা, কাজীর হাট স্লুইসের স্থানে আজও কোনো ব্রিজ হয়নি।ফলে ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার উত্তরাঞ্চলের মানুষ,চরসাহাভিকারীর ও চরপার্বতীর পূর্ব- দক্ষিন অঞ্চলের সোনাগাজী–কোম্পানীগঞ্জ সংযোগ প্রত্যাশী জনগণ আজও নৌকার ওপর নির্ভরশীল।
নৌকা ভাড়া বেশি, যাত্রা ঝুঁকিপূর্ণ, বয়স্ক মানুষ বা গর্ভবতী নারীদের জন্য এ যেন এক দৈনিক দুর্ভোগ।
আরো সমস্যা,উওর চরসাহাভিকারী মৌজায় চরপার্বতী জনগনের অনেক জমি ক্রয় করা, ও পৈতৃক সুএে পাওয়া জমিতে চাষাবাদে হিমশীম, ফসল আনা নেওয়ায় নানাবিধ সমস্যা, চরম পর্যায়ে ভোগান্তি ও আর্থিক ক্ষতি। এসব বিষয়ে এলাকার মানুষ জন রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি পান, কিন্তু সময় পেরিয়ে যায়, কাজের দেখা মেলে না।
প্রশাসনের কেউ এ নিয়ে তেমন মাথা ঘামায় না।
চরপার্বতীর মানুষ আজও বলে
যদি কেউ সত্যি কাজ করত, তাহলে আজ নদীর উপরে সেতুটা দাঁড়িয়ে যেত।এর পর যে সমস্যা মুখোমুখি হবে তাহা শুধু চরপার্বতী গ্রাম নয়, নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা আংশিক সীমান্ত উপজেলা বা গ্রাম নদীর গর্ভে বিলীন হয়েছে, হচ্ছে চলমান
মুসাপুর সুইচগেট ভাঙন—নতুন দুঃস্বপ্ন
২০২৪ সালের ২৪ আগস্ট, ভারতের তীব্র বন্যায় তারা তাদের ডেম্বু বাঁধের সুইচগেট খুলে দেয়।
অতিরিক্ত পানির চাপে মুসাপুর সুইচগেট ভেঙে যায়।
এ যেন ২০০২-এর ভয়াবহতার পুনরাবৃত্তি।
১৫ মাস কেটে গেছে— এখনো নতুন সুইচগেট নির্মাণ শুরু হয়নি।মানুষ অসহায়, জমি তলিয়ে যাচ্ছে, ফসল নষ্ট, মাছের ঘের ভেসে গেছে, আর প্রশাসন নীরব দর্শক।উপজেলা ও জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি,ঢাকা প্রেসক্লাবে মানববন্ধন,
সব কিছুই হয়েছে — কিন্তু ফল শূন্য।কেউ যেন চরপার্বতীর কান্না শুনতে পায় না।নদীর তীরে মানুষের লড়াই যখন সরকারের দৃষ্টি এলো না, তখন এগিয়ে আসে গ্রামের মানুষ।দেশ–বিদেশে থাকা প্রবাসীরা চাঁদা তুলে পাঠান প্রায় ২০লক্ষ টাকা,
সেই টাকায় কিনে আনা হয় জিও ব্যাগ। জোযার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ৯ নং ওয়ার্ড কাজী হানিফ সেতু সংলগ্ন জিও ব্যাগ ভরাট করে কাজ শুরু করা হয়, অনেকে স্বেচ্ছায় শ্রম দেন, এলাকাবাসী আর্থিক অনুদান দেন, এর পর শুরু হয় সড়ক রক্ষার কাজ, চরপার্বতী ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড সড়ক সংলগ্ন মৌলভী আবদুর রহিম মসজিদের পূর্ব হতে ৫০০ ফুট পর্যন্ত জিও ব্যাগ ভরাট করে রাস্তার দক্ষিন পাশ বাধঁ দেয়া হয়, বসুরহাট টু মৌলভীবাজার টু কাজীর হাট সুইচগেট সড়ক আপাতত রক্ষা হয় যাহা এলাকাবাসী সহ নের্তত্বে স্থানীয় চেয়ারম্যান, কাজী হানিফ আনসারী, বিএনপি নেতা কাউসার আলম বায়তুল ৭ নং ওয়ার্ড মেম্বার আবদুল্লাহ আল মামুনের উদ্যোগে নদীর পাড়ে জিও ব্যাগ ভরাট করে রাস্তা ভাঙন রোধ করা হয়। পরবর্তীতে জেলা প্রশাসক
২০০ জিও ব্যাগ সরবরাহ করেন। কাজ চলতে থাকে, সাময়িক সমাধান হয়। এ গল্প যেন এক মানবিক ঐক্যের প্রতিচ্ছবি—যেখানে সরকার ব্যর্থ, সেখানে সাধারণ মানুষ দাঁড়ায় নিজের অস্তিত্ব রক্ষায়। কিন্তু সমস্যা শুধু নদী ভাঙ্গন নয়, মানুষের কৃএিম সমস্যা বন্দোবস্ত করলো, যাহা গভীর উদ্বেগ ভাবায়,
নদীর তীরে তরুন, তরুণীদের মিলন মেলা—এক নতুন সমস্যা, চরপার্বতীর, মৌলবি আবদুর রহিম জামে মসজিদ থেকে পূর্বদিকে প্রায় ৫০০ ফুট জায়গায় নদীর তীরে বিকেলবেলা ভিড় জমে।কেউ আসে জোয়ার–ভাটা দেখতে, কেউ আসে নদীর রূপে হারিয়ে যেতে।তরুণ-তরুণী, শিশু-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ—সবাই আসে এক আশ্চর্য আকর্ষণে।কেউ কেউ একে বলে “মিনি সৈকত”।কিন্তু এই আনন্দের আড়ালেও লুকিয়ে আছে সামাজিক উদ্বেগ।অবাধ মেলামেশা, ভ্রাম্যমাণ দোকান, খাবারের স্টল—সব মিলিয়ে ধীরে ধীরে নষ্ট হচ্ছে এলাকার ধর্মীয় ও নৈতিক পরিবেশ।মসজিদের পাশেই ভিড় জমে, সড়কে বসে খাবার বিক্রি—
যা সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্গে বেমানান।
আজ না হয় দৃশ্যমান বিনোদন,
কিন্তু আগামী দিনে এ জায়গা যদি অনৈতিক কর্মের আশ্রয়স্থল হয়ে পড়বে মনে করেন স্হানীয় এলাকাবাসী। এই দীর্ঘ নদীভাঙন, স্লুইসগেট ধ্বংস, কৃষিক্ষেত্র নষ্ট,সব মিলিয়ে চরপার্বতীর মানুষ এখন অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত।এক সময় যাদের জীবিকা ছিল ধান, মাছ ও গবাদি পশু,তারা এখন বেকার, কেউ প্রবাসে পাড়ি দিয়েছে, কেউ শহরে রিকশা চালায়।
নারীরা হারিয়েছে কাজের সুযোগ,শিশুরা স্কুলে যেতে পারে না, কারণ রাস্তা ভেঙে গেছে।
গ্রামের অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে, সামাজিক বন্ধন দুর্বল।তবু মানুষ বাঁচে,কারণ বেঁচে থাকা তাদের একমাত্র প্রতিবাদ।
চরপার্বতীর মানুষ জানে
নদীর সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকাই জীবনের নাম।”তারা চায় উন্নয়ন, কিন্তু সে উন্নয়ন যেন বাস্তব হয়।
একটি ব্রিজ, একটি টেকসই সুইচগেট—
এগুলোই আজ তাদের স্বপ্ন।
তারা চায় সরকার, প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা এই কণ্ঠস্বর শুনুক।
চায় যেন চরপার্বতীর মানুষ আর কাঁদতে না হয় নদীর গর্জনের তালে।
নদী যেন অভিশাপ নয়, আশীর্বাদ হয়
চরপার্বতীর গল্প কোনো এক গ্রামের গল্প নয়—
এটা বাংলাদেশের উপকূলীয় জীবনের প্রতিচ্ছবি।
যেখানে নদী জীবন দেয়, আবার কেড়ে নেয়;
যেখানে মানুষ বারবার ভেঙে পড়ে, আবার দাঁড়িয়ে যায়।চরপার্বতীর মানুষের মুখে একটাই আহ্বান—
আমাদের নদীকে রক্ষা করুন,
আমাদের ভবিষ্যৎকে ফিরিয়ে দিন।”
যদি সময়ের স্রোতে এই আহ্বান পৌঁছে যায় নীতিনির্ধারকদের কানে,তবে হয়তো একদিন নদীর তীরে দাঁড়িয়ে চরপার্বতীর শিশুরা বলবেএই নদীএকদিন আমাদের গ্রাম ভাসিয়ে নিয়ে যায়নি,বরংজীবন দিয়েছে।”